দীপক সাহা।।
শীতের শেষে বসন্তে প্রকৃতি নতুন রূপ ধারণ করে। রুক্ষ খোলস ছেড়ে রঙিন সাজে সেজে ওঠে প্রকৃতি। সূর্যের উত্তরায়ণের সূচনায় বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আর এই উত্তরায়ণ শুরু হয় ফাল্গুনি পূর্ণিমায়, চাঁদ তখন ফাল্গুনি নক্ষত্রের পাশ দিয়ে যায়। তখন দেশের নানা প্রান্তে লোকসমাজে উৎসব পালিত হয়। সেগুলিই কালক্রমে হোলি উৎসবে পরিণত হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুনে হোলি উৎসবের নাম খাড়ি হোলি। উত্তর ভারতের মানুষের কাছে যা ‘হোলি’, বাংলা ও ওড়িশার মানুষের কাছে ‘দোলযাত্রা’। আবার দাক্ষিণাত্যে এর নাম ‘সিঙ্গা’। আর একেবারে দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা এই উৎসবকে বলে থাকে ‘কমন্নম হবন’। আসামে হোলির নাম ফাকুওয়া। মণিপুরের হোলির নাম ইয়াওসাং। উত্তরপ্রদেশে হোলি বা দোল লাঠমার নামেই পরিচিত। রাজস্থানের রয়্যাল হোলিতে বসন্তের প্রাণোচ্ছ্বলতা প্রকাশিত হয় একেবারে রাজকীয় ঢঙে।হরিয়ানায় দোল উৎসবের নাম দুলন্দি হোলি। পঞ্জাবে হোলির পরের দিন পালন করা হয় হোলা মহল্লা। গুরু গোবিন্দ সিং এই মেলার প্রচলন করেছিলেন। মহারাষ্ট্র আর মধ্যপ্রদেশে দোল উৎসব রং পঞ্চমী নামে বিখ্যাত। তবে বাংলা ও ওড়িশায় যে দোল উৎসব পালিত হয় ফাল্গুনি পূর্ণিমায়, উত্তরভারতে সেই উৎসব পালিত হয় পূর্ণিমা কেটে গেলে প্রতিপদে।
মূলত পুরীতে দোলোৎসব ফাল্গুন মাসে প্রবর্তনের যে রেওয়াজ হয়, সেখান থেকেই বাংলায় চলে আসে এই সমারোহ। দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলো মূলত দুই প্রকার: প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা মেড়াপোড়া সংক্রান্ত, এবং দ্বিতীয়টি রাধা ও কৃষ্ণের দোললীলা বা ফাগুখেলা কেন্দ্রিক কাহিনি।
বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনি পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলনায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনি পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।
স্কন্দপুরাণের ‘ফাল্গুন মাহাত্য’ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ নিজে যুধিষ্ঠিরকে দোলযাত্রার বিবরণীতে সত্যযুগের রাজা রঘুর রাজত্বে শিবের প্রসাদপ্রাপ্ত ঢুণ্ডা রাক্ষসীর উৎপাতের কথা বর্ণনা করেন। দোলের ঠিক আগে চাঁচড় উৎসবের দিনে সেই ঢুণ্ডা বধের প্রথার কথা। আবার অন্য পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু নিজের বোন হোলিকাকে নিযুক্ত করেছিলেন আপনপুত্র হরিভক্ত প্রহ্লাদকে বধ করার জন্য। হোলিকা প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চাইলেও বিষ্ণুর আশীর্বাদে প্রহ্লাদ রক্ষা পায়৷ আর হোলিকা নিজে আগুনে মারা যায়। এই হোলিকা রাক্ষসীর নাম থেকেই হোলি উৎসবের উদ্ভব। হোলিকাকে পোড়ানোর মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী রীতি-নীতি অনুসরণ করে যে কেউ, তার জীবনের সমস্ত নেতিবাচক বিষয়গুলি দূর করে এবং একটি ইতিবাচক কাজ শুরু করে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আরিয়ান জাতির কাছ থেকে এই উৎসবের জন্ম। হোলি উৎযাপনের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে থেকেই হোলি উদযাপিত হয়ে আসছে। এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায় খ্রিস্ট জন্মেরও প্রায় ৩০০ বছর আগের পাথরে খোদাই করা একটি ভাস্কর্যে। এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে হিন্দু পবিত্র গ্রন্থ বেদ এবং পুরাণেও। ৭০০ শতকে দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটিকাতেও হোলি উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। পরে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রকর্মে হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে। বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ যা রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে। ‘কামসূত্রে’দোলায় বসে আমোদ-প্রমোদের কথা আমরা জানতে পারি। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্নাবলী’ এবং অষ্টম শতকের ‘মালতী-মাধব’ নাটকেও এর বর্ণনা পাওয়া যায়। জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ ও ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও এই উৎসবের অস্তিত্ব রয়েছে। সম্রাট আকবরের অন্তঃপুরে হোলি খেলার চিত্র রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘কথা’ কাব্যগ্রন্থেও এর উল্লেখ আছে।
অতীতের কলকাতাতেও বর্ধিঞ্চু পরিবারে দোলযাত্রা পালিত হতো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম হলেও ঠাকুর বাড়িতে দোলের দিন যথেষ্ট মাতামাতি হতো। দোল উপলক্ষে সেই সময় সঙও বেরোত। এমনকী দোলের সময় জামাইবাড়িতে দোলের তত্ত্ব পাঠানোর রীতি ছিল। ইংরেজরা প্রথম দিকে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ‘ল্যুপেরক্যালিয়া’ হিসেবেই মনে করেছিল। অনেকে আবার একে গ্রীকদের উৎসব ‘ব্যাকানালিয়া’-এর সঙ্গেও তুলনা করত। ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছুটির তালিকা থেকে জানা যায় দোলযাত্রার সময় পাঁচদিন ছুটি পাওয়া যেত।
তবে পৌরাণিক কিংবা ঐতিহাসিক পথ ছাড়িয়ে দোল উৎসব নান্দনিক রূপ পায় রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। সেখানে দোল উৎসবে সবার রঙে রঙ মেলানোর আহ্বান। যা হয়ে ওঠে হৃদয়ে বসন্তের উৎসব। এই বসন্ত উৎসবকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতিও যেন এক বর্ণিল সাজে সেজে ওঠে। দোলের আগের দিন বৈতালিকের গান, গৌরপ্রাঙ্গনে রঙে রঙে রাঙা হয়ে ওঠার আহ্বান। বসন্তের মোলায়েম স্পর্শে সকলের কণ্ঠে ভেসে আসে –ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল। শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। রবি ঠাকুর ১৯২৫ সালে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন। আদিবাসী ও অন্যান্যদের নিয়ে শুরু করা সেই দিনের উৎসব এখনো একই ভাবে রীতিনীতি অনুসরণ করে চলছে।
দোল উৎসবের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছেন রাধা-কৃষ্ণ। আবিরে ভেসে যাওয়া, রঙের খেলা, বাঙালির ইতিহাসে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্যদেব সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বৃন্দাবন, মথুরা, নবদ্বীপ, মায়াপুরে এখন রঙিন মানুষের ঢল। এই দিনে মানুষ তাদের সব সমস্যা ভুলে,নতুন রঙে এবং নতুন ভাবে তাদের সম্পর্ক শক্তিশালী করে তোলে। এই উৎসব মানুষের মধ্যে ভালবাসা বাড়ায়। এই দিনটি ঐতিহ্যবাহী ও সাংস্কৃতিক উৎসব, এই উৎসব শুধু হিন্দুদের উৎসব নয় এই উৎসব সর্বজনীন। হোলি রং এবং প্রেমের উৎসব। দোলযাত্রা মূলত একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব বলেই বিবেচিত হয়। তাহলেও সর্ব ধর্মের মানুষের সান্নিধ্যের মধ্য দিয়েই উৎসবের আসল প্রাপ্তি।
হোলি উৎসবে সমাজের উঁচু নিচু ভেদাভেদ মিশে যায়। এই দিন সবাই রঙিন। দোল বা হোলি ধর্মীয় অনুষঙ্গের আড়ালে থাকা এক সামাজিক অনুষ্ঠানও, যার সর্বজনীন আবেদন আছে। দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এখন আর শুধুমাত্র সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে হোলি খেলা নয়, বরং সব ধর্মের নারী পুরুষের মধ্যেই রং খেলার প্রবণতা দেখা যায়। হোলি একটি পবিত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে যুক্ত আনন্দের উৎস। আসুন সবাই একসঙ্গে এই উৎসবের মর্যাদা রাখি এবং আনন্দে এই উৎসব উদযাপন করি। সুখশান্তি সবাই মিলে ভাগ করে নিই এবং হোলির রঙ্গে সবাই রঙিন হই। আসুন ভেদাভেদ ভুলে সবাই মিলে দোল বা হোলি উৎসবের অসাম্প্রদায়িক সত্যকে উদ্ঘাটন করি। এই দিনে বাতাসে যেন একটাই সুর বয়ে চলে “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে”।
Leave a Reply